ইতিহাসের সাহসী নারী

ইতিহাসের সাহসী নারী

এম. নজরুল ইসলাম:

‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটি যেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। এ কথা সত্য যে প্রত্যেক সার্থক পুরুষের নেপথ্যে থাকেন একজন নারী। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সেই মহিয়সী নারী, যিনি নিজেকে নেপথ্যে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর অভীষ্টের দিকে এগিয়ে যেতে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নরনারী প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘গৃহগঠন এবং গৃহবিচ্ছেদ স্ত্রীলোকেই করিয়া থাকে। আমাদের দেশে ভালোমন্দ সমস্ত শক্তি স্ত্রীলোকের হাতে; আমাদের রমণীরা সেই শক্তি চিরকাল চালনা করিয়া আসিয়াছে। আমাদের দেশীয় গৃহিণী, লোকলৌকিকতা-আত্মীয়কুটুম্বিতা পরিপূর্ণ বৃহৎ সংসার এবং স্বামী-নামক একটি চলৎশক্তিরহিত অনাবশ্যক বোঝা পশ্চাতে টানিয়া লইয়া আসিয়াছে। …সে যখনই ভালোবাসিতে আরম্ভ করে তখনই তাহার কর্তব্য আরম্ভ হয়; তখনই তাহার চিন্তা, বিবেচনা, যুক্তি, কার্য, তাহার সমস্ত চিত্তবৃত্তি সজাগ হইয়া উঠে, তাহার সমস্ত চরিত্র উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতে থাকে। বাহিরের কোনো রাষ্ট্রবিপ্লব তাহার কার্যের ব্যাঘাত করে না, তাহার গৌরবের হ্রাস করে না, জাতীয় অধীনতার মধ্যেও তাহার তেজ রক্ষিত হয়।’

কবিগুরুর এই কথাগুলির মতোই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনে তাঁর সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভ‚মিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার তুলে এনেছেন তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বা তাঁর রেনু প্রসঙ্গ। মহীয়সী এই নারীর আত্মত্যাগ শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর প্রতি নয়, দেশের প্রতিও। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখো তোমার জীবনের কাহিনী।’ …হঠাৎ মনে হলো লিখতে ভালো না পারলেও ঘটনা যত দূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কী? সময় তো কিছু কাটবে।…আমার স্ত্রী, যার ডাকনাম রেনু- আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছে। রেনু আরো একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।”

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরো লিখছেন, ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি যে অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ কালা কিংবা আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময় আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি একআনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তাঁর দান যথেষ্ট রয়েছে।’

মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ। তিনি তাঁর সচেতন বোধ এবং নিজস্ব চিন্তাচেতনায় তাঁর সময়কে যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন মাত্রা লাভ করে নিঃসন্দেহে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে তাঁর মাকে নিয়ে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি তাঁর মাকে যেন নয়, এক সর্বংসহা মহিয়সী নারীকে তুলে ধরেছেন। ঐ বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘একটার পর একটা ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। কিন্তু একটা জিনিস আমি বলব যে, আমার মাকে আমি কখনও ভেঙে পড়তে দেখিনি। কখনও যত কষ্টই হোক আমার বাবাকে বলেননি যে, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা চলে আস বা সংসার কর বা সংসারের খরচ দাও। কখনও না।

…সংসারটা কীভাবে চলবে সম্পূর্ণভাবে তিনি নিজে করতেন। কোনোদিন জীবনে কোনো প্রয়োজনে আমার বাবাকে বিরক্ত করেননি। মেয়েদের অনেক আকাংক্ষা থাকে স্বামীদের কাছ থেকে পাবার। শাড়ি, গহনা, বাড়ি, গাড়ি, কত কিছু!…এত কষ্ট তিনি করেছেন জীবনে; কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেননি। চাননি।

…আইয়ুব খান যেদিন মার্শাল ল’ ডিক্লেয়ার করলেন আব্বা করাচিতে ছিলেন। তাড়াতাড়ি চলে এলেন, ঐ দিন রাতে ফিরে এলেন। তারপরই ১১ তারিখ দিবাগত রাতে অর্থাৎ, ১২ তারিখে আব্বাকে গ্রেফতার করা হলো। আমার দাদি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে যে নগদ টাকা ছিল, আমাদের গাড়ি ছিল, সব সিজ করে নিয়ে যাওয়া হলো।

…অত্যন্ত ধৈর্য্যরে সঙ্গে আমার মাকে দেখেছি সে অবস্থা সামাল দিতে। মাত্র ৬ দিনের নোটিস দিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল। মালপত্তর নিয়ে রাস্তার ওপর আমরা ছোট ছোট ভাইবোন। তখন রেহানা খুবই ছোট। একজন একটা বাসা দিল। দুই কামরার বাসায় আমরা গিয়ে উঠলাম। দিনরাত বাড়ি খোঁজা আর আব্বার বিরুদ্ধে তখন একটার পর একটা মামলা দিচ্ছে। এই মামলা মোকদ্দমা চালানো, কোর্টে যাওয়া এবং বাড়ি খোঁজা, সমস্ত কাজ আমার মা অত্যন্ত ধৈর্য্যরে সঙ্গে করতেন।…কখনও অভাব কথাটা মায়ের কাছ থেকে শুনিনি। এমনও দিন গেছে বাজার করতে পারেননি। আমাদের কিন্তু কোনোদিন বলেননি, আমার টাকা নেই, বাজার করতে পারলাম না।
লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘…জাতির সাহসী ও মমতাময়ী জননী হয়ে সেই রক্তের সঙ্গে নিজের রক্ত মিশিয়েছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। কৃতজ্ঞ জাতির কাছে তিনি তাই বঙ্গমাতা। …এই মহীয়সী নারীর জীবন পরম গৌরবের। একদিকে তিনি জাতির পিতার পত্নী, শহীদ সন্তানদের জননী এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনারও জন্মদাত্রী।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘রেনু আমার পাশে না থাকলে এবং আমার সব দুঃখকষ্ট, অভাব-অনটন, বারবার কারাবরণ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনযাপন হাসিমুখে মেনে নিতে না পারলে আমি আজ বঙ্গবন্ধু হতে পারতাম না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামেও যুক্ত থাকতে পারতাম না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় সে আদালতে নিত্য হাজিরা দিয়েছে এবং শুধু আমাকে নয়, মামলায় অভিযুক্ত সবাইকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি জেলে থাকলে নেপথ্যে থেকে আওয়ামী লীগের হালও ধরেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা লিখছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনের নায়িকা রেণু পুতুলের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরও কখনো কেঁদে বুক ভাসাননি। পুতুল নয়, বরং রেণুর নিজের সংসারই চলেছে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে। মূলত শৈশবেই রেণু বঙ্গবন্ধুর জীবন চলার সঙ্গী হয়ে এলেও কৈশোর বা তারুণ্যের প্রণয়পাশা দিয়ে তাঁর জীবন গড়ে ওঠেনি। বরং রাজনীতিবিদ স্বামী, যিনি কখনো থেকেছেন ঢাকায়, কলকাতায় কিংবা কারাগারে, সেই স্বামীর সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন নিজের সংসারের চাকা। কেমন করে পারলেন রেণু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো একজন বহির্মুখী, বহুবার কারাবরণকারী রাজনীতিবিদের সংসারকে সামলে নিতে?’ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে একজন অসাধারণ প্রজ্ঞার মানুষ হিসিবে উল্লেখ করে দেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁর ‘বঙ্গমাতা : ইতিহাস সচেতনতার মানুষ’ নিবন্ধে লিখছেন, ‘তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একজন সাহসী নারী। দুর্বার সাহসে ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে দিয়েছিলেন দূরদর্শী চিন্তার বার্তা। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ ফেলার সাহসী বার্তা তাঁকে ইতিহাসের মানুষ করেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জেন্ডার সমতার ইতিহাসে তিনি আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ।’

শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এভাবেই বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের সাহসী মানুষ হয়ে। আজ তাঁর জন্মদিনে প্রণতি জানাই তাঁকে।

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং
অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও লেখক

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on google
Google+
Share on email
Email
Share on print
Print

Leave a Comment

Your email address will not be published.

সর্বশেষ খরব
bassl

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে Afzalur Rahman Babu ভাই য়ের পরামর্শে ঝরেপরা শিশুদের নেয়ে কেক কাটা ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ:

bassl

ময়মনসিংহ সদর উপজেলা চরাঞ্চলের প্রয়াত নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল এর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান অম্বিকাগঞ্জ কলেজ কর্তৃক আয়োজিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২ তম জন্মদিন

ছবিতে খবর দেখুন
Scroll to Top